মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে খোলা চিঠি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবায়নের আহ্বান।

মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়,
আমি বাংলাদেশের একজন সাধারণ নাগরিক, শিক্ষক এবং শিক্ষানুরাগী হিসেবে আজ আপনার নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমপিও এবং স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও) আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষার্থী প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত, যারা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলেছে একটি ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য। এই শিক্ষকদের অধিকাংশই অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করছেন, যাদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় সাহায্য এবং সহযোগিতা প্রয়োজন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বড় অংশজুড়ে থাকা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং হতাশাজনক। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত হাজার হাজার শিক্ষক ও কর্মচারী প্রতিনিয়ত আর্থিক, মানসিক এবং পেশাগত নানা সংকটে ভুগছেন। জাতীয়করণই একমাত্র উপায়, যা তাদের এই সংকট থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, আমি আজ আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করা এখন সময়ের দাবি।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান অবস্থা শিক্ষকদের জীবনযাপন:
বর্তমানে, বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুল, কলেজ, এবং মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষকরা অত্যন্ত নিম্নমানের বেতন, অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধা এবং চাকরির অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ শিক্ষক কর্মচারী সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকায় তাদের জীবনযাপন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা এবং কর্মস্থলে নিরাপত্তা একেবারেই সন্তোষজনক নয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকরা সাধারণত যে বেতন পান, তা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাঁরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সমপরিমাণ বেতন, বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা সুবিধা, পেনশন, এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতন নিয়মিতভাবে প্রদান করা হয় না, যা তাদেরকে আর্থিক সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। এমনকি শিক্ষকদের চাকরির নিরাপত্তা নেই, যা তাদের পেশাগত জীবনে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এই সমস্যাগুলো কেবল ভূক্তভুগী শিক্ষক তাদের পরিবারকেই প্রভাবিত করছে না, বরং সামগ্রিকভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করছে।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের প্রয়োজনীয়তা এখন কেনো সময়ের দাবিঃ
. শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা মর্যাদা: শিক্ষকদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি উন্নত মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থার পূর্বশর্ত। জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষকদের সমান বেতন কাঠামো, চিকিৎসা সুবিধা, পেনশন এবং অন্যান্য আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এতে করে শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে এবং তারা সমাজে সম্মানজনক অবস্থানে আসতে পারবেন।
২. অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব: অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ ন্যূনতম বেতনও পান না। বেতন কাঠামোতে ব্যাপক বৈষম্য থাকায় অনেক শিক্ষক কর্মচারী তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরত শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন অত্যন্ত কম, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা পূরণে পর্যাপ্ত নয়।
. পেনশন অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত: বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো পেনশন বা অবসরকালীন তেমন সুযোগ-সুবিধা নেই। তারা বেতন ভাতা ছাড়াও উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জাতীয়করণ হলে শিক্ষকরা এই সুবিধাগুলো পাবেন, যা তাদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবে।
. চাকরির নিরাপত্তাহীনতা: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের চাকরির কোনো স্থায়ীত্ব নেই। প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনা পর্ষদ চাইলে যে কোনো মুহূর্তে শিক্ষক বা কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করতে পারে, যা তাদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। চাকরির নিশ্চয়তা না থাকায় শিক্ষকেরা একটি স্থিতিশীল জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারেন না।
৫. বদলি জনিত অসুবিধা: বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকরা সাধারণত বদলির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন, যা তাদের জন্য একটি বড় ধরনের অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এই সুবিধাটি না থাকায় শিক্ষকরা একই জায়গায় দীর্ঘদিন কাজ করতে বাধ্য হন। অনেক ক্ষেত্রেই পরিবার থেকে দূরে থাকায় তাদের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবনে সংকট সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে, নারীরা তাদের কর্মক্ষেত্র এবং পরিবারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হন।
৬. প্রশিক্ষণ পেশাগত উন্নয়নের অভাব: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে অধিকাংশ শিক্ষকই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত উন্নয়নের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেভাবে শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তেমনটি বেসরকারি ক্ষেত্রে প্রায় অনুপস্থিত। জাতীয়করণ করলে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
. পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব: অনেক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, ল্যাবরেটরি এবং অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রী। ফলে, এসব প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

জাতীয়করণের সম্ভাব্য উপকারিতা:
. শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণ:  জাতীয়করণের ফলে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একক নীতিমালার আওতায় আসবে। এর ফলে, শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও মানসম্মত শিক্ষক শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য হবে। 
. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয়করণের ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা যাবে। আর্থিক অনিয়ম এবং দুর্নীতির সুযোগ কমবে এবং সরকারি তত্ত্বাবধানে থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো আরও কার্যকরভাবে পরিচালিত হবে। 
. শিক্ষার সর্বজনীন অধিকার বাস্তবায়ন: জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষাকে সকলের জন্য সহজলভ্য এবং সমতা ভিত্তিক করা সম্ভব হবে। সকল শিশু তরুণরা সমানভাবে শিক্ষার সুযোগ পাবে, যা জাতীয় উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। 
. শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে অগ্রগতি: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ করা হলে শিক্ষার্থীরা মানসম্পন্ন গবেষণার সুযোগ পাবে। গবেষণা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বিষয়গুলো আরও গতিশীল হবে। 
. শিক্ষকদের মানোন্নয়ন কর্মস্থলের পরিবেশ উন্নয়ন: শিক্ষকরা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে অধিক স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন। তাদের আর্থিক সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কর্মস্থলে একটি সুস্থ, সুন্দর শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
৬. শিক্ষার মানোন্নয়ন: জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থায় সমতা ও মানোন্নয়ন সম্ভব। সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য একরূপ নীতিমালা প্রণয়ন করা সম্ভব হবে, যা শিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক হবে। সব শিক্ষার্থী একই মানের শিক্ষা উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধা পাবে।
৭. সমাজে শিক্ষার প্রসার:  শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জাতীয়করণে শিক্ষার প্রসার এবং মানোন্নয়নে একটি ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে। সরকারি নীতিমালার অধীনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হলে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। এতে দেশের প্রতিটি প্রান্তে শিক্ষা প্রসারিত হবে এবং বৈষম্য হ্রাস পাবে।
. শিক্ষা ব্যবস্থায় সমতা আনয়ন: শিক্ষার ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ থাকা উচিত। কিন্তু বর্তমানে সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। জাতীয়করণ করলে এই বৈষম্য দূর হবে এবং সকল শিক্ষার্থী সমান সুযোগ পাবে। 
. শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা: জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে। কারণ জাতীয় মানের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের সঠিক দক্ষতা, জ্ঞান এবং যোগ্যতা অর্জনে সহায়ক হবে। এতে করে শিক্ষার্থীরা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। 
১০. বৈষম্য দূরীকরণ: জাতীয়করণের মাধ্যমে গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও উন্নত সুযোগ-সুবিধা পাবে। এতে করে শহর এবং গ্রামের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যে বৈষম্য রয়েছে তা দূর হবে। সব শিক্ষার্থী সমান সুযোগ পাবে এবং দেশের শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে।

জাতীয়করণের পথে চ্যালেঞ্জ আমাদের প্রত্যাশা:
মাননীয় শিক্ষা উপদেষ্টা মহোদয়, আমরা জানি, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জাতীয়করণের প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং চ্যালেঞ্জপূর্ণ হতে পারে। তবে এটি কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন নয়; এটি একটি সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নের পদক্ষেপ। আমরা আশা করি, আপনি এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে জাতীয়করণের জন্য একটি শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়ন করবেন এবং তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। 
আশা করছি, আপনার নেতৃত্বে আমরা শীঘ্রই একটি ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাবো। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা এবং সমস্যাগুলো দূর করতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, এমনটি প্রত্যাশা করছি। আমরা একটি উন্নত, ন্যায্য, এবং সমতামূলক শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি যেখানে সকল শিক্ষক শিক্ষার্থী সম্মানের সাথে বাঁচতে এবং শেখার সুযোগ পাবেন। আপনার সক্রিয় ভূমিকা আমাদের এই স্বপ্ন পূরণে সহায়ক হবে।
 
আপনার সুস্বাস্থ্য সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করি।
 
শ্রদ্ধাসহ  
আহমেদ হোসেন।
উত্তরা, ঢাকা
০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

আরো পড়ুনঃ

1 Comments

  1. সুন্দর লিখেছেন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Previous Post Next Post