![]() |
এমপিওর দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষক। ফাইল ছবি। |
নন-এমপিও শিক্ষকদের(অনার্স-মাস্টার্স ও ডিগ্রির তৃতীয় শিক্ষক) ‘ভাগ্য বিপর্যয়’ কাটবে কবে? বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেসরকারি কলেজগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কলেজগুলোর অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই আছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে এমপিওভুক্ত (মাসিক পেমেন্ট অর্ডার) হওয়ার জন্য আন্দোলন করছেন। প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক এমপিওভুক্ত হওয়ার দাবি নিয়ে বছর ধরে আন্দোলন করে আসছেন, কিন্তু এখনো পর্যন্ত তাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এই শিক্ষকদের কর্মজীবন অনিশ্চয়তায় ভরপুর, তারা বেতন ও অন্যান্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, যা তাদের জীবনের মানকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের নন-এমপিও শিক্ষকদের সংকট, তাদের আন্দোলন, সরকারের পদক্ষেপ এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা দরকার।
বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের বর্তমান অবস্থা: বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের অনেকেই মাসের পর মাস বেতন পান না। এমপিওভুক্ত না হওয়ায় তারা সরকারি কোনো সুবিধা পান না, যেমন— উৎসব ভাতা, পেনশন, চিকিৎসা ভাতা, প্রভিডেন্ট ফান্ড ইত্যাদি। এই শিক্ষকদের বেশিরভাগই মাত্র কয়েক হাজার টাকায় দিন কাটাতে বাধ্য হন, যা তাদের জীবনযাত্রার মানকে নিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে আনে। তাদের অধিকাংশেরই নেই চাকরির নিশ্চয়তা, আর্থিক সুরক্ষা, এবং সামাজিক মর্যাদা।
এমপিওভুক্তির জন্য আন্দোলন: এমপিওভুক্তির জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা। ২০১৩ সাল থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তারা দাবি আদায়ে আন্দোলন করেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন, র্যালি, অবস্থান কর্মসূচি, অনশনসহ নানা ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমেও তারা তাদের দাবি তুলে ধরেছেন। এছাড়াও তারা প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য সরকারি দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের অবহেলা ও অনীহা তাদের আশা ভঙ্গ করেছে বারবার।
শিক্ষক নেতারা মনে করেন, সরকারি পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চরম উদাসীনতা, দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবের কারণে তাদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া থমকে আছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কৃচ্ছ্রতা নীতি এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতার কারণে শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি হচ্ছে না।
সরকারের পদক্ষেপ ও ব্যর্থতা: সরকারের বিভিন্ন সময় শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০২১ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির প্রস্তাব অনুমোদন দেয়নি। তাছাড়া, ডিগ্রি স্তরের তৃতীয় শিক্ষকদেরও এমপিওভুক্তির প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি একাধিকবার জানিয়েছেন যে, তারা এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করছেন, কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাধার কারণে তারা সফল হতে পারছেন না। শিক্ষামন্ত্রী অর্থ মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা চেয়েছিলেন, কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাড়া না পাওয়ায় সমাধান আসে নি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা: জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্য বিভিন্ন সময় তথ্য সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে, এই তথ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছিলো। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সব বেসরকারি কলেজের নন-এমপিও শিক্ষকদের তালিকা চেয়েছিলো। কিন্তু এই তালিকা সংগ্রহের পরও তাদের এমপিওভুক্তির ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি।
শিক্ষকদের জীবনে প্রভাব: এমপিওভুক্তির অভাবে এই শিক্ষকদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। তারা আর্থিকভাবে দৈন্যদশায় ভুগছেন। অধিকাংশ শিক্ষক তাদের পরিবারকে সুষ্ঠুভাবে চালাতে পারছেন না। সন্তানদের সুশিক্ষা প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা এবং মৌলিক চাহিদা পূরণ করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে বেসরকারি চাকরি অথবা টিউশনি করছেন।
সামাজিক মর্যাদা ও পেশাগত উন্নয়ন: নন-এমপিও শিক্ষকরা শুধু আর্থিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, তাদের সামাজিক মর্যাদাও কমছে। তারা তাদের অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় পেশাগত মর্যাদায় অবনতি হচ্ছে। অন্যদিকে, সরকারি, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, যা দুই শ্রেণির শিক্ষকের মধ্যে বৈষম্যের সৃষ্টি করছে।
শিক্ষার মানের ওপর প্রভাবল: নন-এমপিও শিক্ষকদের অর্থনৈতিক সংকট তাদের শিক্ষাদানের মানের ওপরও প্রভাব ফেলছে। তারা মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছেন না, যা উচ্চশিক্ষার মানের অবনতির কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। শিক্ষকদের আর্থিক অনিশ্চয়তা তাদের মধ্যে হতাশা এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে, যা সরাসরি শিক্ষার মানে প্রভাব ফেলে।
অর্থ বিভাগের ভূমিকা: অর্থ বিভাগের কঠোর অবস্থান এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। অর্থ বিভাগ শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির প্রস্তাবগুলোকে অনুমোদন দিচ্ছে না এবং কৃচ্ছ্রতা নীতির অজুহাতে প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত করছে। তাদের দাবি, এমপিওভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ করা সম্ভব নয়। তবে শিক্ষকদের দাবি, অর্থ বিভাগের অনীহা তাদের অসহায় অবস্থার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব: অনেক শিক্ষক নেতা মনে করেন, রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাবও তাদের সংকটের মূল কারণ। তাদের মতে, যদি সরকারের রাজনৈতিক ইচ্ছা থাকত, তাহলে অর্থ বিভাগ এতদিনে তাদের এমপিওভুক্তির অনুমোদন দিত। রাজনৈতিক নেতারা কেবল প্রতিশ্রুতি দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য: সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি একাধিকবার বলেছিলেন যে, তারা শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির চেষ্টা করছেন। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের কঠোর নীতির কারণে তারা সফল হতে পারছেন না। তিনি আরও বলেছিলেন, "আমরা এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে প্রস্তাব পাঠিয়েছি, কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন দিচ্ছে না। আমরা আশা করছি যে তারা বিষয়গুলো বিবেচনা করবে।"
শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ: শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তারা আশঙ্কা করছেন যে, যদি দ্রুত তাদের এমপিওভুক্ত না করা হয়, তাহলে তারা বড় ধরনের আর্থিক এবং সামাজিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবেন। শিক্ষকেরা তাদের দাবির পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যাবেন, কিন্তু কবে নাগাদ তাদের এই দাবি পূরণ হবে, তা নিয়ে তারা আশঙ্কিত।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে দাবি
আমরা, বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের নন-এমপিও শিক্ষকগণ, দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক সংকট ও বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমাদের এমপিওভুক্তির দাবিতে চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে, আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে অনুরোধ জানাই:
১. দ্রুত আমাদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
২. শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে।
৩. এমপিও নীতিমালার সংশোধন করে নন-এমপিও শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
৪. শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা ও আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
৫. শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের অবদান স্বীকৃতি দিতে হবে।
আপনাদের ত্বরিত পদক্ষেপ আমাদের ভবিষ্যৎ ও শিক্ষার মান রক্ষায় সহায়ক হবে।
বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকট। এই সংকটের সমাধান করতে হলে প্রয়োজন অর্থ মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের যৌথ উদ্যোগ এবং রাজনৈতিক ইচ্ছা। শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি শুধু তাদের আর্থিক সুরক্ষা দেবে না, বরং শিক্ষার মানও উন্নত করবে। তাই এই সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন, যাতে শিক্ষকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে পারেন এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত হয়।
আরো পড়ুনঃ https://arhossain.blogspot.com/2024/08/blog-post_28.html
Post a Comment