নন-এমপিও শিক্ষকরা যাবেন কোথায়? তাদের ভবিষ্যৎ কী?
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের শূন্য পদের বিপরীতে বদলির দাবি দীর্ঘদিনের। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে পুরুষ, মহিলা
উভয় শিক্ষকদের নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে প্রায় ৩০০-৪০০ কিলোমিটার দুরে চাকরি করতে হচ্ছে। চাকরির জন্য দূর দুরান্তে থাকতে
হচ্ছে।
সংবাদে প্রকাশ, গত ২৪ ও ২৫ আগস্ট টানা দুইদিন শূন্য পদে বদলির দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছেন ইনডেক্সধারী শিক্ষকরা। ২৭ আগস্ট, ২০২৪ অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তাদের দাবি মেনে নিয়েছেন বলে দাবি করেছেন আন্দোলনত শিক্ষকরা।
সচিবালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন একদল শিক্ষক। তারা তাদের কষ্টের কথা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের কষ্টের কথা শোনার পর তিনি তাদের সকল দাবি মেনে নিয়েছেন বলে জানা যায়। দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিদপ্তর নির্বিশেষে শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেবেন বলে কথা দিয়েছেন।
পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নন-এমপিও (অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে পাঠদানকারী) শিক্ষকরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নন- এমপিও শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনার্স এবং মাস্টার্স স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। তবে তাদের কাজের স্বীকৃতি এবং আর্থিক সুবিধা অন্য শিক্ষকদের তুলনায় অত্যন্ত সীমিত। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচুর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত নয়, ফলে সেখানে কর্মরত শিক্ষকরা বেতন এবং অন্যান্য আর্থিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নিয়োগ বিধিমালা স্পষ্ট থাকলেও তা অমান্য করে এই শিক্ষকদের বেতন সাধারণত ৪০০০ টাকা থেকে ৯০০০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে জীবনধারণের জন্য অপর্যাপ্ত। এছাড়াও তারা বাড়িভাড়া ভাতা, ঈদ বোনাস, প্রমোশন, চিকিৎসা ভাতা এবং অন্যান্য ভাতার সুবিধা থেকেও বঞ্চিত।
নন-এমপিও শিক্ষকদের বেতন
কাঠামো অত্যন্ত দুর্বল। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে মাসে মাত্র ৪০০০ টাকা থেকে ৯০০০ টাকার মধ্যে তাদের বেতন সীমাবদ্ধ,
যা বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় একজন ব্যক্তির মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়।
এই সীমিত আয়ের মাধ্যমে একজন শিক্ষক তার পরিবারকে পর্যাপ্তভাবে সহায়তা করতে পারেন না,
যা তাদের জীবনের মানকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এছাড়াও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য
বৃদ্ধি এবং বাসস্থান, চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচের কারণে তাদের আর্থিক সংকট প্রতিনিয়ত
বাড়ছে।
শহরাঞ্চলে বসবাসরত শিক্ষকদের জন্য বাড়িভাড়া একটি বড় সমস্যা। নন-এমপিও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত বাড়িভাড়া ভাতা নেই। ফলে অনেক শিক্ষককে তাদের সীমিত আয়ের মধ্য থেকে বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে হয়, যা তাদের বেতনের একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলে। কিছু শিক্ষক শহরতলিতে বা দূরের গ্রামে বসবাস করতে বাধ্য হন, যা তাদের জন্য পরিবহন ব্যয় এবং সময়ের অপচয় বাড়িয়ে দেয়। এই অবস্থায় তাদের মানসিক চাপও বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশে ঈদ উৎসবকে ঘিরে বোনাসের একটি প্রচলন রয়েছে। কিন্তু নন-এমপিও শিক্ষকরা এই সুবিধা থেকেও বঞ্চিত থাকেন। ঈদ বোনাস ছাড়াও অন্যান্য ভাতা, যেমন চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা বা কোনো বিশেষ ভাতা তাদের জন্য নেই। এই ধরনের ভাতার অভাবে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে যখন কোনো শিক্ষক গুরুতর অসুস্থতায় ভোগেন, তখন তারা চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে যথাযথ চিকিৎসা নিতে পারেন না।
নন-এমপিও শিক্ষকদের আরেকটি বড় সমস্যা হলো প্রমোশন বা পদোন্নতির অভাব। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা চাকরির বিভিন্ন স্তরে পদোন্নতির সুযোগ পেয়ে থাকেন, কিন্তু নন- এমপিও শিক্ষকরা এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন। তারা বছরের পর বছর একই পদে কাজ করে থাকেন, কিন্তু তাদের কাজের মূল্যায়ন বা পদোন্নতির কোনো সুযোগ থাকে না। এছাড়াও, তাদের চাকরির নিরাপত্তা নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ চাইলে যে কোনো সময় তাদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দিতে পারে, যা তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলে।
নন-এমপিও শিক্ষকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ একটি সাধারণ সমস্যা। তারা একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের তুলনায় অধিক চাপ এবং অসম্মানের সম্মুখীন হন। তাদের শিক্ষাদানের মান এবং কাজের দায়িত্ব একই হলেও তারা বৈষম্যের শিকার হন। কর্মক্ষেত্রে এই বৈষম্যমূলক আচরণ তাদের মানসিক অবস্থাকে প্রভাবিত করে এবং তাদের কাজের আগ্রহ কমিয়ে দেয়।
নন-এমপিও শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করছেন। তারা বেতন বৃদ্ধি, প্রমোশন এবং ভাতা প্রদানের দাবিতে বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় নেমেছেন এবং সরকারের কাছে তাদের দাবি পেশ করেছেন। তবে তাদের দাবিগুলো এখনো পূরণ হয়নি। এই শিক্ষকদের আন্দোলন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সামাজিক সুরক্ষার প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে।
নন-এমপিও শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাদের বেতন কাঠামো উন্নত করা, বাড়িভাড়া ভাতা প্রদান, ঈদ বোনাস ও অন্যান্য ভাতা নিশ্চিত করা এবং চাকরির নিরাপত্তা প্রদান করা উচিত। শিক্ষকদের কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করার জন্যও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের নন-এমপিও শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন এবং পেশাগত চ্যালেঞ্জসমূহ অত্যন্ত গুরুতর। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য এই শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক। তাদের দাবি পূরণ এবং অধিকার নিশ্চিত না হলে শিক্ষা ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন সময়ে এমপিওভুক্তির দাবিতে ‘আমরণ অনশন’ কর্মসূচি পালন করেছেন নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। বিভিন্ন মহল আশ্বস্ত করলেও ফলাফল শুণ্য।
এই অবস্থায় বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ করা সময়ের দাবি। শিক্ষা জাতীয়করণ হলে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারিভাবে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে, যাতে শিক্ষা খাতের বৈষম্য দূর হয়। এটি শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে সহায়তা করবে। জাতীয়করণ হলে সকল শিক্ষকের বেতন, ভাতা, প্রমোশন, এবং অন্যান্য সুবিধা সমানভাবে নিশ্চিত হবে। এতে নন এমপিও শিক্ষকরাও আর্থিক নিরাপত্তা পাবেন এবং তাদের পেশাগত জীবন উন্নত হবে। জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যা শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে সহায়ক হবে।
লেখক
আহমেদ হোসেন।
একটি বেসরকারী কলেজের প্রভাষক।
২৮ আগস্ট, ২০২৪
উত্তরা, ঢাকা।
আরো পড়ুনঃ
https://arhossain.blogspot.com/2024/09/blog-post_3.html
https://arhossain.blogspot.com/2024/08/blog-post_28.html
https://arhossain.blogspot.com/2024/08/blog-post_29.html
অনতিবিলম্বে সকল ননএমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এমপিও ভূক্তির জন্য একান্ত অনুরোধ করছি। ননএমপিও, সুপার, শাকদাহ দাখিল মাদরাসা, কলারোয়া, সাতক্ষীরা।
ReplyDeletePost a Comment