শ্রম বলতে কি বুঝায়? শ্রমের বৈশিষ্ট্য এবং গুরুত্ব (What is meant by Labor? Characteristics and Importance of Labor)

অর্থনীতি একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা সম্পদের উৎপাদন, বন্টন, এবং ব্যবহারের উপর আলোকপাত করে। অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো শ্রম। শ্রম বলতে মানুষের দ্বারা পরিচালিত শারীরিক বা মানসিক কাজকে বোঝায় যা কোনো পণ্য বা সেবার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যয় করা হয়। সাধারণত শ্রম দুইভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়: শারীরিক শ্রম এবং মানসিক শ্রম।

শ্রমের সংজ্ঞা

শ্রম হলো সেই প্রচেষ্টা যা একজন ব্যক্তি মজুরি বা উপার্জনের বিনিময়ে কোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ব্যয় করেন। এটি অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মূল চালিকা শক্তি, কারণ কোনো পণ্য বা সেবার উৎপাদনের জন্য মানুষের কাজ প্রয়োজন হয়।

শ্রমের বৈশিষ্ট্য

১. মানব সম্পদ: শ্রম একটি মানবিক কার্যকলাপ। এটি মানুষ দ্বারা পরিচালিত হয় এবং তার বুদ্ধি, শারীরিক শক্তি এবং দক্ষতার উপর নির্ভর করে।

২.  শারীরিক ও মানসিক শ্রম: শ্রম দুটি প্রধান প্রকারে বিভক্ত: শারীরিক শ্রম এবং মানসিক শ্রম। শারীরিক শ্রম এমন কার্যক্রম যা শারীরিক পরিশ্রমের সাথে সম্পর্কিত এবং মানসিক শ্রম চিন্তা, পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজের সাথে সম্পর্কিত।

৩. শ্রেণীভিত্তিক ভিন্নতা: শ্রম বিভিন্ন ধরণের কাজের প্রকারভেদে ভিন্ন হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষিকাজে ব্যবহৃত শ্রম এবং একটি অফিসের প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত শ্রমের ধরন এক নয়।

৪. পরিমাপযোগ্যতা: শ্রমকে সময়, পরিশ্রম বা দক্ষতার মাধ্যমে পরিমাপ করা যায়। সাধারণত এটি ঘন্টা বা দিনে কাজের হিসাব করা হয়।

৫. খরচ: শ্রমের জন্য নির্দিষ্ট খরচ থাকে, যাকে মজুরি বলা হয়। শ্রমের মজুরি বিভিন্ন মানদণ্ডে নির্ধারিত হয়, যেমন: কাজের ধরণ, শ্রমিকের দক্ষতা এবং শ্রমের সময়কাল।

৬. উৎপাদন ক্ষমতা: শ্রম পণ্যের উৎপাদন এবং সেবার গুণগত মানে সরাসরি প্রভাব ফেলে। শ্রমের গুণগত মান বেশি হলে উৎপাদনের ফলাফলও ভালো হবে।

৭. সীমাবদ্ধতা: শ্রমের একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে কারণ এটি মানুষের শক্তি এবং সময়ের উপর নির্ভর করে। মানুষের শারীরিক এবং মানসিক শক্তি সীমিত এবং সেইসাথে সময়ও সীমাবদ্ধ।

৮. দক্ষতা: শ্রমের মানের উপর দক্ষতার প্রভাব রয়েছে। দক্ষ শ্রমিক অদক্ষ শ্রমিকের তুলনায় অধিক কার্যকরী ও উৎপাদনশীল হয়।

৯. বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা: দক্ষ শ্রম গঠনের জন্য প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা দরকার। এ কারণে শ্রমের উন্নয়নে বিনিয়োগ প্রয়োজন।

১০. অবিচ্ছেদ্য সংযোগ: শ্রম এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া একে অপরের সাথে গভীরভাবে সংযুক্ত। কোনো অর্থনৈতিক কার্যক্রম শ্রম ছাড়া অসম্ভব।

শ্রমের গুরুত্ব

১. অর্থনৈতিক উন্নয়ন: শ্রম উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি।

২. উৎপাদন বৃদ্ধিতে ভূমিকা: দক্ষ শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদনের গুণগত মান এবং পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, যা সামগ্রিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।

৩. উৎপাদনের জন্য প্রধান উপাদান: শ্রম হলো উৎপাদনের প্রধান উপাদান। মেশিন এবং অন্যান্য উপকরণ থাকলেও মানুষের শ্রম ছাড়া উৎপাদন সম্ভব নয়।

৪. রোজগার ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন: শ্রমের মাধ্যমে মানুষ উপার্জন করতে পারে যা তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। শ্রমের দ্বারা সমাজের অর্থনৈতিক মজবুতি বৃদ্ধি পায়।

৫. সামাজিক পরিবর্তন: শ্রমের মাধ্যমে মানুষ নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে। শ্রমের গুরুত্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সম্পর্কিত।

৬. মানব সম্পদের বিকাশ: শ্রমের মাধ্যমে মানব সম্পদ তৈরি হয় এবং এর উন্নয়ন ঘটে। দক্ষতা অর্জন এবং নতুন কাজের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে শ্রম মানুষের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।

৭. কৃষি, শিল্প এবং সেবাখাতে অবদান: শ্রম কৃষি, শিল্প এবং সেবাখাতে প্রত্যক্ষভাবে অবদান রাখে, যা দেশের অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ।

৮. শিল্পের উন্নতি ও আধুনিকায়ন: শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে শিল্পের উন্নতি ঘটে এবং নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ে, যা অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করে তোলে।

৯. জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি: শ্রম জাতীয় উৎপাদনে সরাসরি অবদান রাখে। শ্রমের দক্ষতা এবং পরিমাণ বাড়লে জাতীয় উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।

১০. বিনিয়োগের বৃদ্ধি: শ্রম বাজারের উন্নতির সাথে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। নতুন কর্মসংস্থান এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে শ্রমের ভূমিকা বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে।

এভাবেই শ্রম অর্থনীতির অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয় এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে সফল করতে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

Post a Comment

Previous Post Next Post