শ্রম বিভাগ (Division of Labor) কী?
শ্রম বিভাগ অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় কাজের বিভাজনকে বোঝায়। শ্রম বিভাগ বলতে একটি বৃহৎ কার্যক্রমকে ছোট ছোট বিভিন্ন কাজ বা ধাপে ভাগ করে প্রতিটি কর্মীকে নির্দিষ্ট কাজ দেওয়া হয়, যাতে তারা নিজেদের কাজের বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠতে পারেন। এভাবে কাজের দক্ষতা বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদনের সময় ও খরচ কমে আসে।
শ্রম বিভাগ কার্যকর করার মাধ্যমে প্রতিটি কর্মী একটি নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়াটি আরো সুশৃঙ্খল ও দ্রুত হয়ে যায়। এটি উৎপাদনের গুণগত মান ও পরিমাণ উভয়ই বৃদ্ধি করে। অ্যাডাম স্মিথ তার বিখ্যাত গ্রন্থ "The Wealth of Nations"-এ শ্রম বিভাগের গুরুত্ব এবং প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
শ্রম বিভাগের প্রকারভেদ
শ্রম বিভাগের বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রধানত চারটি প্রকারভেদ আলোচনা করা হয়েছে:
১। সরল বা পেশাগত শ্রম বিভাগ (Simple or Occupational Division of Labor): সরল বা পেশাগত শ্রম বিভাগ হলো সেই প্রকার যেখানে কাজ সরাসরি পেশার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়। অর্থাৎ, একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট পেশার কাজ করেন এবং অন্যরা অন্য পেশার কাজ করেন। উদাহরণস্বরূপ, একজন কৃষক কেবল কৃষিকাজ করবেন, একজন শিক্ষক কেবল পড়াবেন, একজন ডাক্তার চিকিৎসা করবেন ইত্যাদি।
২। শিল্প-ভিত্তিক শ্রম বিভাগ (Industrial Division of Labor): এই প্রকারে একটি শিল্পের অভ্যন্তরে বিভিন্ন উৎপাদন প্রক্রিয়া বিভিন্ন ব্যক্তির উপর ভাগ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি গার্মেন্টস কারখানায় কেউ কাটিং করবে, কেউ সেলাই করবে, কেউ ফিনিশিং করবে, আবার কেউ গুণগত মান পরিদর্শন করবে।
৩। জটিল শ্রম বিভাগ (Complex Division of Labor): জটিল শ্রম বিভাগে একটি বড় কাজকে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করে প্রতিটি অংশের জন্য নির্দিষ্ট দক্ষতা সম্পন্ন শ্রমিক নিযুক্ত করা হয়। এটি সাধারণত বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় দেখা যায়, যেখানে একত্রে অনেকেই বিভিন্ন ধরণের কাজ করেন।
৪। আঞ্চলিক শ্রম বিভাগ (Regional Division of Labor): আঞ্চলিক শ্রম বিভাগ বলতে বুঝায় যখন কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা দেশ নির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার উৎপাদনে বিশেষজ্ঞ হয়। উদাহরণস্বরূপ, চীন ইলেকট্রনিক পণ্যের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ, ভারত সফটওয়্যার শিল্পে এবং ব্রাজিল কফি উৎপাদনে বিশেষজ্ঞ।
শ্রম বিভাগের সুবিধা
শ্রম বিভাগের অনেক সুবিধা রয়েছে, যার ফলে এটি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিচে শ্রম বিভাগের প্রধান প্রধান সুবিধা উল্লেখ করা হলো:
১। উৎপাদনশীলতার বৃদ্ধি: শ্রম বিভাগ শ্রমিকদের নির্দিষ্ট কাজের উপর বিশেষজ্ঞ করে তোলে, যার ফলে কাজের গুণগত মান বৃদ্ধি পায় এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ে।
২। সময় বাঁচানো: শ্রম বিভাগে কর্মীরা একই কাজ বারবার করে, ফলে কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময় কমে যায় এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া দ্রুত হয়।
৩। দক্ষতার বিকাশ: একটি নির্দিষ্ট কাজে বিশেষজ্ঞ হওয়ার ফলে কর্মীরা দক্ষ হয়ে ওঠেন, যা উৎপাদনের গুণগত মান বাড়াতে সহায়ক হয়।
৪। সুবিধাজনকভাবে মেশিন ব্যবহার: শ্রম বিভাগ মেশিন ব্যবহারের সুযোগ বাড়ায়, কারণ প্রতিটি কাজ একটি নির্দিষ্ট মেশিন দ্বারা করা যায়।
৫। উৎপাদন খরচ কমানো: দক্ষতা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ কমে যায় এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলি লাভবান হয়।
৬। সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন: শ্রম বিভাগ উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনার সুযোগ তৈরি করে, কারণ শ্রমিকেরা নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে নতুন ধারণা ও পদ্ধতি নিয়ে কাজ করতে পারেন।
৭। বিনিময়ের সুবিধা: আঞ্চলিক শ্রম বিভাগ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিময়ের সুবিধা বৃদ্ধি করে, কারণ অঞ্চলভিত্তিক বিশেষজ্ঞরা একে অপরের প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করতে পারেন।
৮। উৎপাদনের মান উন্নয়ন: বিশেষজ্ঞ শ্রমিকরা কাজের সময় পণ্যের গুণগত মানের দিকে নজর দেন, ফলে পণ্যের মান উন্নত হয়।
৯। কাজের উৎসাহ বৃদ্ধি: শ্রমিকরা যখন তাদের পছন্দের এবং দক্ষতার কাজ করেন, তখন তারা কাজে অধিক উৎসাহী হয়ে ওঠেন।
১০। আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির সাথে খাপ খাওয়ানো: শ্রম বিভাগ আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতি এবং প্রযুক্তির সাথে খাপ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে।
শ্রম বিভাগের অসুবিধা
যদিও শ্রম বিভাগের অনেক সুবিধা রয়েছে, তবুও এর কিছু অসুবিধাও বিদ্যমান। নিচে শ্রম বিভাগের ১০টি অসুবিধা উল্লেখ করা হলো:
১। কাজের একঘেয়েমি: একটি নির্দিষ্ট কাজ বারবার করতে করতে শ্রমিকরা একঘেয়েমি এবং ক্লান্তির সম্মুখীন হন, যা কাজের মান কমিয়ে দেয়।
২। দক্ষতা হারানোর ঝুঁকি: শ্রমিকরা যদি একটি নির্দিষ্ট কাজের বাইরে অন্য কোনো কাজ না করতে পারেন, তবে তারা অন্যান্য দক্ষতা হারিয়ে ফেলতে পারেন।
৩। কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতা: শ্রম বিভাগ কর্মসংস্থানের সুযোগকে সংকুচিত করে, কারণ বিশেষজ্ঞ শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের নির্দিষ্ট কাজেই যোগ্য হন।
৪। সমাজে বৈষম্য সৃষ্টি: শ্রম বিভাগের ফলে বিভিন্ন পেশার মধ্যে আয় ও সামাজিক মর্যাদার বৈষম্য তৈরি হয়।
৫। মানুষের সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত: যেহেতু শ্রমিকরা একটি নির্দিষ্ট কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন, তাই তাদের সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হয়।
৬। কাজের উপর নির্ভরতা: শ্রম বিভাগের কারণে কর্মীরা একে অপরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, ফলে একটি ছোট ভুলও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
৭। অর্থনৈতিক ঝুঁকি: নির্দিষ্ট অঞ্চলে একটি পণ্য বা শিল্পের উপর নির্ভরশীল হলে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। যদি ওই পণ্যের বাজারে মন্দা দেখা দেয়, তবে পুরো অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৮। স্বাস্থ্যগত সমস্যা: দীর্ঘ সময় ধরে একই কাজ করতে করতে শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
৯। নিয়ন্ত্রণের অভাব: শ্রমিকরা শুধুমাত্র তাদের নির্ধারিত কাজের প্রতি দায়িত্বশীল থাকেন, ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ার অন্যান্য ধাপগুলি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
১০। কাজের মান কমানো: শ্রমিকরা একঘেয়েমির কারণে কাজের প্রতি আগ্রহ হারাতে পারেন, যা শেষ পর্যন্ত উৎপাদনের মান কমিয়ে দেয়।
এইভাবে, শ্রম বিভাগ অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়ক হলেও এর কিছু নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে, যা বিবেচনা করা জরুরি।
Post a Comment