তীব্র নিন্দা: বেসরকারি কলেজ অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পুলিশের লাঠিচার্জ!
আমরা গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দার সঙ্গে উল্লেখ করছি যে, গত ১৭ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে রাজধানীতে বেসরকারি কলেজ অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দাবিতে আয়োজিত শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে পুলিশ যে অমানবিক লাঠিচার্জ ও সহিংস আচরণ করেছে, তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। এই ন্যায্য দাবি আদায়ে যারা আন্দোলন করছেন, তারা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তাদের এই সম্মানিত ও শান্তিপূর্ণ দাবির প্রেক্ষিতে পুলিশি নির্যাতন শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকার প্রশ্নে নয়, দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েও গভীর শঙ্কার সৃষ্টি করেছে।
বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা এমপিওভুক্তির দাবি নিয়ে দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছেন। এই দীর্ঘ সময় ধরে তারা তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকলেও বারবার আশ্বাস পেয়ে ফিরে গেছেন। যখনই তারা ন্যায্য দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন, তখন তাদের ওপর পুলিশের লাঠিপেটা ও সহিংসতা চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘন। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ও মত প্রকাশের অধিকার আমাদের সংবিধানিক অধিকার, এবং সরকারের দায়িত্ব হলো এই অধিকারকে সম্মান করা এবং রক্ষা করা।
শিক্ষকদের গুরুত্ব এবং তাদের সম্মান: বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা মূলত দুই ধাপে বিভক্ত—সরকারি এবং বেসরকারি। দেশের উচ্চশিক্ষার একটি বিশাল অংশ বেসরকারি কলেজের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যেখানে হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাদের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে অধ্যয়ন করে। এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনার্স এবং মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকরা সরাসরি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিয়ে তাদের মানসিক, সামাজিক এবং পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে থাকেন। তাদের অবদান অমূল্য। কিন্তু সরকার তাদের এমপিওভুক্তি না করে বঞ্চিত রেখে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।
শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে শুধু পাঠদান নয়, শিক্ষার্থীদের মানসিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করা হয়। যারা এই মহান দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের যথাযথ মর্যাদা এবং আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করা সরকারের প্রধান দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি প্রমাণ করছে যে, তাদের এই ভূমিকার যথার্থ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। এমপিওভুক্তির দাবিতে শিক্ষকদের দীর্ঘ আন্দোলন এবং বারবার আশ্বাস পাওয়ার পরও এই সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে, তাদের দাবি ন্যায্য এবং যৌক্তিক।
পুলিশি নির্যাতন ও সহিংসতা: একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন: ১৭ অক্টোবরের এই লাঠিচার্জ ও সহিংসতায় বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের মধ্যে ৩৩ জন আহত হন, যাদের মধ্যে অনেকেই গুরুতর আঘাত পেয়েছেন। এ ধরনের নির্যাতন শুধু শারীরিক ক্ষতি নয়, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতিরও কারণ হয়। শিক্ষকদের ওপর লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড এবং জলকামানের ব্যবহার স্পষ্টতই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বের লঙ্ঘন। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকারীদের ওপর এই ধরনের সহিংস আচরণ কোনো সভ্য রাষ্ট্রে মেনে নেওয়া যায় না।
পুলিশি নির্যাতন সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করে, যা মানুষের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করার অধিকার রক্ষা করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। অথচ, শিক্ষকদের এই শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকারের দায়িত্বশীলতা দেখানোর পরিবর্তে, তাদের ন্যায্য দাবি দমিয়ে রাখার চেষ্টা হয়েছে। এই ধরনের আচরণ কেবল সরকারের শিক্ষানীতির অদক্ষতা এবং মানবাধিকারের প্রতি উদাসীনতার প্রকাশ।
সরকারের ভূমিকা ও দায়বদ্ধতা: এই ঘটনা শুধু একটি নির্দিষ্ট সমস্যার ওপর দৃষ্টি আকর্ষণ করে না, বরং শিক্ষকদের প্রতি সরকারের দায়িত্ববোধের অভাব এবং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সরকারের ব্যর্থতার দিকটিও তুলে ধরে। এমপিওভুক্তির দাবি নতুন কিছু নয়; এটি একটি বহুদিনের পুরোনো এবং ন্যায্য দাবি, যা শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে অপরিহার্য। সরকারের উচিত ছিল এই সমস্যা সমাধানে আগে থেকেই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে শিক্ষকদের আন্দোলনের প্রয়োজন না হয়।
সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা এই মুহূর্তে অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষকদের প্রতি সহিংস আচরণ এবং তাদের ন্যায্য দাবির প্রতি উদাসীনতা দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করবে এবং তাদের পেশাগত জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে, যা পরোক্ষভাবে শিক্ষার্থীদের ওপরও প্রতিক্রিয়া ফেলবে। শিক্ষকদের সম্মান ও অধিকার রক্ষা করা ছাড়া শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন সম্ভব নয়।
দাবি এবং আহ্বান: আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি এবং সরকারের কাছে নিচের দাবি জানাচ্ছি:
১। শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও সহিংসতার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত: এই ঘটনার তদন্ত করে দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
২। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়া: শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের এমপিওভুক্তির দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন: ভবিষ্যতে শিক্ষকদের ন্যায্য আন্দোলন দমনের জন্য কোনো ধরনের পুলিশি সহিংসতা বা হস্তক্ষেপ যেন না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।
৪। শিক্ষকদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা: বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরা যাতে উপযুক্ত আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা পেতে পারেন, সে লক্ষ্যে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫। শিক্ষার মান উন্নয়নে শিক্ষকদের ভূমিকা স্বীকৃতি দেওয়া: সরকারের উচিত শিক্ষকদের ভূমিকা যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা এবং তাদের পেশাগত জীবনে উন্নয়নের জন্য আরও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া।
শিক্ষকদের ওপর পুলিশের লাঠিচার্জ শুধু একটি সহিংস ঘটনা নয়, এটি শিক্ষকদের সম্মান, অধিকার এবং মৌলিক মানবাধিকারের ওপর আঘাত। এই ধরনের ঘটনা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং শিক্ষকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করতে হলে শিক্ষকদের সম্মান ও তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।
আমরা আশা করি, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং শিক্ষকদের প্রতি সুবিচার করবে। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিয়ে তাদের এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা হবে, যাতে তারা নিশ্চিন্তভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন এবং দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হন।
এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা শিক্ষকদের প্রতি সরকারের উদাসীনতা ও অগ্রহণযোগ্য আচরণে নিন্দা জানাই এবং শিক্ষকদের প্রতি সম্মান ও সুবিচার দাবি করছি।
Post a Comment