বন্যার সময় বয়স্কদের জন্য করণীয়
বন্যা হলো পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বন্যার প্রকোপ বেড়েছে এবং এটি জীবনের স্বাভাবিক গতিপ্রবাহকে বিঘ্নিত করছে। বিশেষত, সমাজের একটি বিশেষ অংশ যেমন বয়স্করা, যাদের শারীরিক সক্ষমতা কমে গেছে এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যগত জটিলতা থাকে, তারা বন্যার সময় আরও বেশি অসহায় হয়ে পড়ে। এজন্য বন্যার সময় বয়স্কদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি ও করণীয় রয়েছে। এই প্রবন্ধে বন্যাকালীন সময়ে বয়স্কদের জন্য করণীয় বিষয়গুলো আলোচনা করা হবে।
বন্যার পূর্বে প্রস্তুতি
বন্যা আসার আগেই কিছু পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি কারণ তাদের শারীরিক শক্তি কম এবং দ্রুত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা কম। তাই পরিবারের সদস্য বা অভিভাবকদের এই প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে।
১. পরিকল্পনা এবং যোগাযোগ: বন্যার সময় যদি বিদ্যুৎ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যাহত হয়, তবে বয়স্কদের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকা উচিত। পরিবারের সদস্যদের সাথে বন্যা পরিস্থিতিতে কোথায় জড়ো হতে হবে, কিভাবে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানো হবে—এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা উচিত। জরুরি পরিস্থিতিতে যোগাযোগের বিকল্প পদ্ধতি যেমন বেতার যোগাযোগ বা বিশেষ ইন্টারকম ব্যবস্থা প্রস্তুত রাখা উচিত।
২. জরুরি কিট প্রস্তুত করা: বন্যার পূর্বেই একটি জরুরি কিট প্রস্তুত রাখা উচিত, যা বয়স্কদের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। এই কিটে পানি, শুকনো খাবার, প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র, পোশাক, টর্চলাইট, ব্যাটারি, এবং গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া যদি বয়স্ক ব্যক্তিরা চোখের চশমা বা অন্যান্য সহায়ক সামগ্রী ব্যবহার করেন, তবে সেগুলোও কিটে রাখতে হবে।
৩. স্বাস্থ্যগত প্রস্তুতি: অনেক বয়স্ক ব্যক্তিরই দীর্ঘমেয়াদী রোগ থাকে, যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি। তাদের ঔষধের পর্যাপ্ত মজুদ রাখা প্রয়োজন যাতে বন্যার সময় কোন বাধার সম্মুখীন না হতে হয়। পাশাপাশি ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধের তালিকা এবং প্রয়োজনীয় চেকআপগুলি সম্পন্ন করা উচিত।
৪. গৃহের নিরাপত্তা: বন্যার সময় বয়স্করা যেন সহজেই গৃহ থেকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে পারেন, তার জন্য বাড়ির ভেতরে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ কক্ষগুলোতে পানি ঢুকে যাতে ক্ষতি না করে, তার জন্য পানিনিরোধী দরজা এবং জানালা স্থাপন করতে হবে। এছাড়া বাড়ির নিকটবর্তী উঁচু কোনো স্থান বা আশ্রয়কেন্দ্র চিহ্নিত করা উচিত।
বন্যার সময় করণীয়
বন্যা শুরু হলে এবং জলমগ্নতা বেড়ে গেলে, বয়স্ক ব্যক্তিরা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালিয়ে যেতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন। তাদের সুরক্ষার জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
১. নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তর: বয়স্কদের বন্যার সময় যত দ্রুত সম্ভব নিরাপদ আশ্রয়ে স্থানান্তরিত করা উচিত। সরকারি বা বেসরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে তাদের পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যদি বয়স্ক ব্যক্তিরা হাঁটতে বা চলাফেরা করতে অসুবিধা বোধ করেন, তবে হুইলচেয়ার বা অন্যান্য সহায়ক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা উচিত।
২. স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা: বন্যার সময় পানিবাহিত রোগ এবং অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য বয়স্কদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার। তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায়, রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বেশি। তাই তাদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, যেমন ডাক্তারের সেবা, ঔষধ, এবং প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।
৩. খাবার এবং পানির সরবরাহ: বন্যার সময় পরিষ্কার খাবার এবং পানির সংকট দেখা দেয়। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য পুষ্টিকর খাবার এবং বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তাদের যদি বিশেষ ধরনের খাবার বা ডায়েটের প্রয়োজন হয়, তবে সেই বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত।
৪. মানসিক সমর্থন: বন্যার সময় অনেক বয়স্ক ব্যক্তি মানসিক আঘাতের শিকার হন। তাদের প্রিয়জনদের সাথে বিচ্ছিন্ন হওয়া, আশ্রয়ের অভাব, এবং শারীরিক অক্ষমতা তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে। এজন্য তাদের মানসিক সমর্থন দেয়া জরুরি। পরিবারের সদস্য, স্বেচ্ছাসেবী, এবং সমাজের অন্যান্য ব্যক্তিরা তাদের সাথে কথা বলে তাদের মানসিক শান্তি নিশ্চিত করতে পারে।
৫. সুরক্ষা: বন্যার সময় অনেক ক্ষেত্রে চুরির ঘটনা ঘটে। বিশেষ করে বয়স্কদের গৃহগুলো অধিক ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এজন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা উচিত এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের কাছে মূল্যবান জিনিসপত্র রাখার পরিবর্তে সেগুলো নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা উচিত।
বন্যার পর করণীয়
বন্যার পানি নামার পরও ঝুঁকি রয়ে যায়, বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য। বন্যার পরবর্তী সময়ে তাদের স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষার জন্য কিছু বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: বন্যার পানি নামার পর ঘর-বাড়ি এবং আশপাশের এলাকা পরিষ্কার করতে হবে। বয়স্ক ব্যক্তিরা যেন সংক্রমণ এড়াতে পরিষ্কার পানি এবং সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া মশার উপদ্রব রোধে বাড়ির আশপাশে পানি জমতে না দেয়া গুরুত্বপূর্ণ।
২. স্বাস্থ্য পরীক্ষা: বন্যার পর পানি এবং বাতাসের মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ ছড়ায়। বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য ডাক্তারি পরীক্ষা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে ডায়াবেটিস বা হৃদরোগের মতো দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন।
৩. মানসিক পুনর্বাসন: বন্যার পর মানসিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন হতে পারে। অনেক বয়স্ক ব্যক্তি তাদের ঘর-বাড়ি এবং সম্পত্তি হারিয়ে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, এবং সমাজের অন্যান্য সদস্যদের তাদের সাথে কথা বলে এবং তাদের পাশে থেকে মানসিক শক্তি প্রদান করা উচিত।
সরকারের ভূমিকা
সরকারের উচিত বন্যাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা। বয়স্কদের জন্য আলাদা আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন, তাদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা, এবং পুনর্বাসনের বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।
১. আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন: বয়স্কদের জন্য আলাদা আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা জরুরি যেখানে তাদের বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ঔষধ, চিকিৎসক এবং পরিষ্কার পানির ব্যবস্থা থাকা উচিত।
২. স্বাস্থ্যসেবা প্রদান: বন্যার সময় সরকারকে বয়স্কদের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করতে হবে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা উচিত, যারা বয়স্কদের রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করবেন।
বন্যার সময় বয়স্কদের সুরক্ষার জন্য আমাদের সমাজের সকলের দায়িত্ব পালন করা উচিত। পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি সরকার এবং স্থানীয় সংগঠনগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টায় বয়স্কদের নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব।
Post a Comment