শৈশবের স্থূলতাঃ কারণ ও প্রতিরোধের উপায়।

শৈশবের স্থূলতা একটি ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা প্রায় প্রতিটি দেশ সংস্কৃতিতে দেখা যাচ্ছে। শিশুরা তাদের খাদ্যাভ্যাস, দৈহিক কার্যকলাপ, পরিবেশগত পারিবারিক অভ্যাসের প্রভাবের কারণে অতিরিক্ত ওজন অর্জন করে থাকে। স্থূলতা শিশুর শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং তা ভবিষ্যতে আরও জটিল রোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে। তাই শৈশবের স্থূলতা প্রতিরোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রবন্ধে শৈশবের স্থূলতার কারণসমূহ, প্রভাব প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।

শৈশবের স্থূলতার সংজ্ঞা

শৈশবের স্থূলতা বলতে শিশুর শরীরে অতিরিক্ত চর্বি সঞ্চিত হওয়া বোঝায়, যা তার স্বাভাবিক বৃদ্ধি শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) মতে, যেসব শিশুদের শারীরিক ওজন উচ্চতা বয়সের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং বডি মাস ইনডেক্স (BMI) ৯৫তম শতাংশের উপরে থাকে, তাদেরকে স্থূল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

শৈশবের স্থূলতার কারণসমূহঃ

. অপুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাসশিশুরা আজকাল উচ্চ ক্যালোরি ফ্যাটযুক্ত খাবারের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। ফাস্ট ফুড, প্রসেসড খাবার এবং চিনি স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবারগুলো শৈশবের স্থূলতার একটি প্রধান কারণ। শিশুরা নিয়মিতভাবে চিপস, চকোলেট, কোমল পানীয় ইত্যাদি খেয়ে থাকে, যা তাদের অতিরিক্ত ক্যালোরি যোগ করে।

. দৈহিক কার্যকলাপের অভাববাড়তি ওজনের আরেকটি প্রধান কারণ হলো পর্যাপ্ত দৈহিক কার্যকলাপ না থাকা। আধুনিক প্রযুক্তি ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার শিশুদের বাইরে খেলার বা শারীরিক কার্যকলাপের পরিবর্তে বাড়িতে বসে সময় কাটানোর অভ্যাস তৈরি করছে। টিভি দেখা, ভিডিও গেম খেলা, স্মার্টফোন বা কম্পিউটারে সময় কাটানো শিশুর দৈহিক কার্যকলাপের পরিমাণ হ্রাস করে, যা ওজন বৃদ্ধির কারণ হয়।

. পারিবারিক অভ্যাস জিনগত প্রভাবপরিবারের খাদ্যাভ্যাস জীবনধারার প্রভাব শিশুদের উপর বেশ বড় রকমের প্রভাব ফেলে। যেসব পরিবারে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস রয়েছে, সেসব পরিবারের শিশুদেরও একই রকম অভ্যাস গড়ে ওঠে। তাছাড়া, জিনগত কারণেও শিশুর ওজন বাড়তে পারে। যেসব পরিবারে স্থূলতার ইতিহাস রয়েছে, তাদের শিশুদেরও স্থূলতার ঝুঁকি বেশি থাকে।

. মনের অবস্থা মানসিক স্বাস্থ্যশিশুর মানসিক অবস্থা তার খাদ্যাভ্যাস ওজনের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন, অনেক শিশু মানসিক চাপে বা একাকীত্বে বেশি খাওয়া শুরু করে। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, হতাশা ইত্যাদি শিশুদের অতিরিক্ত খাবার খেতে প্ররোচিত করতে পারে, যা স্থূলতার দিকে নিয়ে যায়।

. পরিবেশগত প্রভাবশিশুর পরিবেশও তার শারীরিক গঠন খাদ্যাভ্যাসে প্রভাব ফেলে। শহরের পরিবেশে সঠিক খেলার স্থান স্বাস্থ্যকর খাবারের অভাব শিশুদের স্থূলতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, প্যাকেটজাত খাবার ফাস্ট ফুডের সহজলভ্যতাও এই সমস্যার একটি বড় কারণ।

শৈশবের স্থূলতার প্রভাব

শৈশবের স্থূলতা কেবল শারীরিক স্বাস্থ্য নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও গভীর প্রভাব ফেলে। স্থূলতার কারণে শিশুরা বিভিন্ন ধরণের শারীরিক জটিলতার সম্মুখীন হতে পারে, যেমন:

. টাইপ ডায়াবেটিসশিশুদের মধ্যে টাইপ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে যখন তারা স্থূল হয়। এটি রক্তে গ্লুকোজের স্তর বৃদ্ধি করে এবং শিশুদের রক্তচাপ, হৃদরোগ, এবং কিডনির সমস্যা বাড়িয়ে তুলতে পারে।

. হৃদরোগের ঝুঁকিস্থূল শিশুদের মধ্যে কোলেস্টেরল রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়, যা ভবিষ্যতে হৃদরোগের সম্ভাবনা তৈরি করে।

. মানসিক সমস্যাস্থূলতার কারণে শিশুরা নিজেদের শরীর নিয়ে হতাশা লজ্জা বোধ করে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব হতাশা দেখা দিতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।

শৈশবের স্থূলতা প্রতিরোধের উপায়

শৈশবের স্থূলতা প্রতিরোধে সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস শারীরিক কার্যকলাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিছু কার্যকর উপায় হলো:

. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলাশিশুদের জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। তাজা ফলমূল, শাকসবজি, প্রোটিন স্বাস্থ্যকর চর্বি শিশুর খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। চিনি ফ্যাটযুক্ত খাবার কমিয়ে সুস্থ সুষম খাবার গ্রহণে শিশুদের উৎসাহিত করতে হবে।

. দৈহিক কার্যকলাপ বৃদ্ধি করাশিশুদের দৈহিক কার্যকলাপ বাড়ানোও স্থূলতা প্রতিরোধে কার্যকর। প্রতিদিন অন্তত ঘন্টা শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণের জন্য তাদের উৎসাহিত করা উচিত। এটি হতে পারে খেলা, দৌড়ানো, সাইকেল চালানো বা সাঁতার কাটা।

. পারিবারিক ভূমিকাপরিবারের সদস্যরা শিশুর খাদ্যাভ্যাস দৈহিক কার্যকলাপে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবারে একসঙ্গে খাওয়া এবং শারীরিক কার্যকলাপে অংশগ্রহণ শিশুর জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে।

. পর্যাপ্ত ঘুমের নিশ্চয়তাঘুমের অভাবও শিশুর ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। তাই প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুমের নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। ঘুমের ঘাটতি শিশুর হরমোনের ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করতে পারে, যা তার ক্ষুধা মেটাবোলিজমে প্রভাব ফেলে।

. স্কুল সমাজের ভূমিকাস্কুল সমাজের উদ্যোগও শৈশবের স্থূলতা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। স্কুলে স্বাস্থ্যকর খাবার সরবরাহ এবং শারীরিক কার্যকলাপের ব্যবস্থা করা উচিত। সমাজে সচেতনতা বৃদ্ধি করে স্থূলতা প্রতিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।

শৈশবের স্থূলতা একটি জটিল সমস্যা হলেও এটি প্রতিরোধযোগ্য। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস, পর্যাপ্ত শারীরিক কার্যকলাপ এবং পরিবারের সক্রিয় ভূমিকা। সমাজ পরিবার একসঙ্গে কাজ করে শিশুদের সুস্থ স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গড়ে তুলতে সহায়ক হতে পারে, যা দীর্ঘমেয়াদে শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যকে সমুন্নত রাখতে সাহায্য করবে।

Post a Comment

Previous Post Next Post