টুলু


টুলু

এ আর হোসেন
০৪/০৬/২০১৪

১.
টুলু
তোকে খুব মনে পড়ছে রে,
তোকে খুব মনে পড়ছে।

২০০৭ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি, সকাল বেলা তোর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল।
তখন তুই ছিলি অনেক ছোট। স্কুলের ছাত্র-ছাত্ররা যখন শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাচ্ছিল তুইও তাদের পিছু পিছু যাচ্ছিলি। অনেক বেদনা আর ভয়ের ছাপ ছিল তোর চোখে মুখে। সবার কাছে তুই ছিলি অপরিচিত।
কেউ তোকে লক্ষ্য করে নি। পায়ের ধুলোয় মিলে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল তোর শরীর। ভিড়ের মধ্যে তুই ছিলি অসহায়। রাস্তা দিয়ে সারি সারি ছাত্র-ছাত্রীরা ফুল হাতে যাচ্ছে শহীদ মিনারে। বড় আপা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন।
ভাগ্যক্রমে তুই বড় আপার নজরে চলে আসলি। তোর মলিন মুখটি দেখে বুঝি বড় আপার অনেক মায়া হয়েছিল। তাইতো তোকে নিয়ে আসলেন বাসায়। প্রথমে তোকে দেখে সবাই যেন কেমন বিরক্ত হয়েছিল। একথা কোনদিন তোকে বলা হয় নি। তবে তুই হয়ত বুঝতে পেরেছিলি।
২.
বাসার সবাই তোকে নিয়ে কত কথা বলাবলি করেছিলাম। তোর কি মনে আছে? মা বললেন তোকে গোসল করিয়ে খাবার খেতে দিতে। কিন্তু তুই অনেক ছোট ছিলি আর শীতও ছিল মোটামুটি। তাই গোসল ছাড়াই তোকে খাবার খেতে দেয়া হলো। তুই গো-গ্রাসে খেয়ে নিলি সবটুকু ! তোর পেটে যে ছিল অনেক ক্ষুধা!
সেইদিনই তোর নাম রাখা হলো। অনেক খোঁজাখুজি করে তোর নাম ঠিক করা হলো “টুলু” । কি করব বল? তুই তো আবার তোর নামও বলতে পারতিস না।
৩.
একদিন দু দিন যায়, দিন বাড়ে তুইও দিনের সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হতে থাকলি। বাসার সবার আপন থেকে আপনতর হতে থাকলি। তোর উপস্থিতিতে বাসার সবার মনে যেন অন্যরকম আনন্দ বিরাজ করতে থাকলো। তোর দুরন্ত চলাফেরা, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, দায়িত্ব-কর্তব্য সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলো। বাসার সবার ভালবাসায় তুইও ভুলে গেলি তোর সব কষ্ট।
বাবা তোকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসতেন। তোকে ভালোবাসার তালিকায় প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। তারপর মা, মেজ আপা, আমি, বড় ভাই, আর বাবু এবং বড় আপা।
টুলু নামটা শোনার জন্য তুই ব্যকুল থাকতি সবসময়। আচ্ছা বলতো, টুলু নামটা তোর অনেক পছন্দ হয়েছিলো?

৪.
তোর কিছু কিছু কথা আজও আমাদের চোখ ভেজায়। তুই কি দেখতে পাস না???
আমার সাথে গোসল করা তোর যেন রুটিন হয়ে গিয়েছিলো। বিরক্ত হয়ে একদিন তোর জন্য মাটির তৈরি গামলার ব্যবস্থা করা হলো। টিয়বয়েলে গোসল করতাম আর তোর জন্য গামলায় পানি ভরে রাখা হতো। ভারি দুষ্টু ছিলি রে!
তোর মত পিচ্চি প্রতিদিন এভাবে গোসল করবে ভাবতেই অবাক লাগতো! সুযোগ পেলেই ঝাপিয়ে পড়তি গোসল করতে।
ক্ষুধা লাগলে তুই পাগলের মত করতি। মা’র কাপড়ের আচল ধরে টানাটানি করতি। আর ইনিয়ে বিনিয়ে কান্না শুরু করতি।
এখন কার সাথে এমন করিস রে টুলু???
সবচেয়ে অবাক লাগত যে তুই কোনোদিন আগে ঘুমাতি না। বাবা বাসায় আসবে তার পরেই তুই ঘুমাতি। বাবা রাত করে বাসায় ফিরতেন। বাসার সামনের রাস্তায় বাবা আসলেই তুই কিভাবে যেন টের পেয়ে যেতি।
বাবাকে সালাম না করে তুই ঘুমাতি না।
বাসার সবার ব্যবহার্য জিনিস পত্রের দিকে ছিল তোর অনেক খেয়াল। কোনকিছু চোখের আড়াল হতে দিতি না।
৫.
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের পাশে আমাদের বাসা। ব্যস্ততম রাস্তা। রাস্তার একপাশে আমাদের বাসা ঠিক ওপাশেই কলেজ। বিকেলে কলেজের মাঠে ক্রিকেট খেলতাম। তুইও যেতি আমাদের সাথে। আমার খেলার সাথি বন্ধুরা, ছোট ভাইয়েরাও তোকে খুব সহজেই আপন করে নিল। আমরা খেলতাম আর তুই শুধু মাঠে দৌড়াতি। তুই তো আর ব্যাটিং বা বোলিং করতে পারতি না। ফিল্ডিং করতি অসাধারণ!
সেদিনও ক্রিকেট খেলছিলাম। তুইও এসেছিলি। আমি বললাম ,“টুলু, বাসায় যা। একা একা কেন এসেছিস? রাস্তায় কত গাড়ি! তোর তো সাহস কম না?”
তুই মাঠে বিশাল এক দৌড় দিলি। মনে হলো আমার কথা তোর ভালো লাগে নি।
সেন্ডেল আর জামা খুলে রেখেছিলাম দূরে। তুই হয়ত ভেবেছিলি আমার নিতে মনে থাকবে না। তাই আমার সেন্ডেল আর জামা নিয়ে দৌড় দিলি বাসার দিকে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম। মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম তোর কাণ্ড দেখে।
তোর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ক্রিকেট খেলায় আবার মনোযোগ দিলাম।
বিকট এক শব্দে খেলা বন্ধ হয়ে গেল। রাস্তায় মাঝেমধ্যেই গাড়ির চাকা ফাটে। ভাবলাম আজও বুঝি তাই হয়েছে।
কিন্তু না। বুকের মাঝে কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠল। তোর সেই দুরন্ত দৌড় আমার চোখে ভেসে উঠল। খেলা বন্ধ করে দৌড়ে রাস্তায় উঠলাম। ইতিমধ্যে বাসার সবাই রাস্তায় এসে উপস্থিত। কারো মুখে কোন কথা নেই। শুধু চোখ দিয়ে অঝরে পানি ঝরছিল।

আমাদের সবার আদরের টুলু আর নেই।

চলন্ত গাড়ির চাকা আমাদের টুলুর দেহ ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে।
মা’র কাছে জানতে পারলাম, আমার জামা আর সেন্ডেল বাসায় রেখেই টুলু আবার আমার কাছে যেতে চেয়েছিল।

৬.
নিজ হাতে টুলুকে কবরে শুইয়ে দিলাম। হাত কাঁপছিল। চোখের পানি বাধ মানছিল না। এখন যে কি বোর্ডে টুলুকে নিয়ে লিখছি আমার হাত কাঁপছে। চোখ দুটো ভিজে যাচ্ছে। টুলু তোকে নিয়ে অনেক কিছু বলার ছিল। আর পারছি না রে। বুকটা কেমন জানি করছে।
যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।

টুলু আমাদের মাঝে বেঁচে ছিল মাত্র পাঁচ মাসের মত।
এখনও মাঝে মাঝে টুলুকে স্বপ্নে দেখি। লাল সাদা রঙের মিশ্রণে নাদুস নুদুস দেহে টুলু আমার দিকে তাকিয়ে তার লেজ নাড়াচ্ছে।

Post a Comment

Previous Post Next Post